ঢাকার আশুলিয়ার কাঠগড়া এলাকায় ছোট একটি বাড়ি নির্মাণ করছিলেন শারীরিক প্রতিবন্ধী আব্দুর রব ব্যাপারী। গত জুনে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) অভিযান চালিয়ে তার বাড়ির বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে। এর পর থেকে নির্মাণকাজ বন্ধ রয়েছে। আশুলিয়া ও সাভারের রাজউকের মহাপরিকল্পনা এলাকার মধ্যে এই এলাকায় কোনো স্থাপনা নির্মাণের আগে রাজউকের অনুমোদন নেওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু আব্দুর রব অনুমোদন নেওয়ার বিষয়টি জানতেন না, তাই বাড়ি নির্মাণের আগে অনুমোদন নেননি। অননুমোদিত ও নকশাবহির্ভূতভাবে নির্মাণাধীন প্রায় ১২০০ ভবনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে রাজউক। তবে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের ঘুষ দাবির অভিযোগও কিছু বাড়ির মালিক করেছেন।
সাভার ও আশুলিয়ার কিছু বাড়ির মালিক অভিযোগ করেছেন, প্রতিটি এলাকায় রাজউকের তথ্যদাতা রয়েছেন। তাদের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালানো হয়। অনুমোদনহীন বা নকশার বাইরে নির্মাণাধীন ভবনের কিছু অংশ ভেঙে দিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়, যার ফলে অন্যান্য বাড়ির মালিকদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে রাজউকের কিছু কর্মকর্তা তথ্যদাতাদের মাধ্যমে বাড়ির মালিকদের কাছ থেকে টাকা আদায় করেন। যারা টাকা প্রদান করে, তাদের বাড়ির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। কাঠগড়া এলাকার আব্দুর রব ব্যাপারীর ছেলে সোহেল হোসেন বলেন, আমাদের বাড়ির পাশেই ছয়তলা জনি ভিলা এবং তার পাশেই একটি পাঁচতলা বাড়ি গড়ে উঠেছে, যাদের কোনো অনুমোদন নেই। তবুও রাজউক তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেনি, অথচ আমাদের বাড়ির কাজ বন্ধ রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কাঠগড়া এলাকার ভুক্তভোগী এক বাড়ির মালিক বলেন, পুনরায় বিদ্যুৎ-সংযোগের ব্যবস্থা করে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে রাজউকের পরিদর্শক পরিচয়ে হাবিবুর রহমান নামের এক ব্যক্তি তাঁর কাছে ৫ লাখ টাকা দাবি করেছিলেন। টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করায় তাঁকে কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত তিন মাসে দুই দফায় রাজউক সাভার পৌর এলাকার ভাটপাড়া মহল্লায় জাহাঙ্গীর নগর হাউজিং সোসাইটিতে অভিযান চালিয়ে অন্তত ২২টি নির্মাণাধীন ৮ থেকে ১০ তলা ভবনের বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এর পর থেকে বিদ্যুতের অভাবে ওই সব বাড়ির নির্মাণকাজ বন্ধ রয়েছে।
গত মে মাসে জাহাঙ্গীর নগর হাউজিং সোসাইটিতে অভিযান চালিয়ে রাজউক ‘বি’ ব্লকের ১৮৪ নম্বর প্লটের নির্মাণাধীন ১০ তলা ভবনের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে। ভবনমালিক রিপন চন্দ্র দাস বলেন, আমাদের ৪,৫০০ বর্গফুট জমির পুরো অংশে ১০ তলা ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। তবে রাজউক নকশায় ২,৭০০ বর্গফুট ছেড়ে দিয়ে মাত্র ১,৮০০ বর্গফুটের মধ্যে নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। নকশাবহির্ভূত নির্মাণের কারণে রাজউক অভিযান চালিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে এবং কাজ বন্ধ করেছে। তিনি আরও উল্লেখ করেন, রাজউকের অনুমোদিত নকশা বা ইমারত নির্মাণ বিধান মেনে সোসাইটিতে কোনো বাড়ি ঠিকভাবে নির্মাণ করা সম্ভব নয়, কেউ তা মানেনও না। সোসাইটিতে আরও দুই শতাধিক ভবন রয়েছে, যাদের উচ্চতা ৮ থেকে ১০ তলা, কিন্তু এই সব ভবনের ক্ষেত্রেও অনুমোদিত নকশা মানা হয়নি এবং তবু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
রিপন দাসের বাড়ির পাশেই ১৩০ নম্বর প্লটে রয়েছে আরও একটি ১০ তলা বাড়ি। ‘জম জম টাওয়ার’ নামের ওই বাড়ির নির্মাণকাজ শেষ হয় বছর দু-এক আগে। গত শনিবার জম জম টাওয়ারে গিয়ে দেখা যায়, চারপাশে কোনো উন্মুক্ত স্থান না রেখেই বাড়িটি নির্মাণ করা হয়েছে। অথচ রাজউক থেকে বাড়িটির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ভবনমালিকদের একজন সৈয়দ আব্দুল মোমিনের স্ত্রী রাহেলা বেগম বলেন, ‘আমরা রাজউকের অনুমোদন নিয়েই বাড়িটি নির্মাণ করেছি। তবে নির্মাণের ক্ষেত্রে অনুমোদিত নকশা মানা হয়েছে কি না, তা বলতে পারব না।’
ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি জাহাঙ্গীর নগর হাউজিং সোসাইটির ‘এ’ ব্লকের ১০২ নম্বর প্লটের নির্মাণাধীন ১০ তলা বাড়ির বিরুদ্ধেও। বাড়িটি দেখভালের দায়িত্বে থাকা জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘রাজউক আমাদের এখানে আসেনি। হয়তো মালিকপক্ষ রাজউকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে।’ এসব বিষয়ে জানতে চাইলে রাজউকের উত্তরা জোনাল অফিসের সদ্য সাবেক অথরাইজড অফিসার ও রাজউক প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত পলাশ শিকদার বলেন, সাভার ও আশুলিয়া এলাকায় পাকা কোনো স্থাপনা নির্মাণের আগে রাজউকের অনুমোদন নিতে হবে এবং অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী ভবন নির্মাণ করতে হবে। যাঁরা এর ব্যত্যয় ঘটিয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সাভার, আশুলিয়াসহ সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত ১ হাজার ২০০ ভবনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ অভিযান চলবে।
অবৈধভাবে নির্মিত কোনো ভবনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, আবার কোনোটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না, এমন প্রশ্নের জবাবে রাজউকের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রিয়াজুল ইসলাম বলেন, অনুমোদনবিহীন বা অনুমোদিত নকশাবহির্ভূতভাবে কোনো ভবনের নির্মাণকাজ চলমান থাকলে সেই সব ভবনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। তবে যেসব ভবনে মানুষ বসবাস শুরু করেছে, তা অবৈধ হলেও সেই সব ভবনের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে বারণ করা হয়েছে।
** অবৈধ ২১ লাখ ভবনের বৈধতা দিতে নতুন নীতিমালা
** মতিঝিলে ৫১ প্লট বেদখল
** ঢাকার ২৬ শতাংশ জলাধার দখলের মুখে

