মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) প্ল্যাটফর্মে অবৈধ অনলাইন জুয়ার লেনদেন ঠেকাতে সব এমএফএস অপারেটরকে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে অপারেটররা বলছেন, এই ধরনের লেনদেন শনাক্ত করা প্রায় অসম্ভব—পার্সন-টু-পার্সন ট্রান্সফারের প্রকৃত উদ্দেশ্য সহজেই শনাক্ত করা যায় না। এছাড়া কিছু এজেন্ট বা মার্চেন্ট একাধিক স্তরের হস্তান্তরের মাধ্যমে এমএফএস অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে জুয়া সাইটে বড় অঙ্কের অর্থ পাঠাচ্ছেন, যা ট্রেস করা আরও কঠিন করে তোলে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্প্রতি দেশের ১৩টি এমএফএস সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দিয়েছে। এমএফএস প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে অবৈধ জুয়ার মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচার হচ্ছে বলে সতর্ক করে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে জরুরি ভিত্তিতে সন্দেহজনক অ্যাকাউন্টগুলোর তালিকা তৈরি করার নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
চিঠিতে সব এমএফএস প্রতিষ্ঠানকে টাস্ক ফোর্স গঠন করতে ও এআই-যুক্ত স্বয়ংক্রিয় মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া জুয়া-সংক্রান্ত অভিযোগ জানানোর জন্য পাবলিক রিপোর্টিং পোর্টাল ও হেল্পলাইন চালুর নির্দেশনাও দেওয়া হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি সূত্র জানিয়েছে, জুয়া-সংক্রান্ত লেনদেন প্রতিরোধে গৃহীত পদক্ষেপের কার্যকারিতা পর্যালোচনা করতে বাংলাদেশ ব্যাংক ৬ নভেম্বর সাতটি এমএফএস অপারেটরের সঙ্গে বৈঠক করবে। দেশ থেকে অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে ঠিক কত পরিমাণ অর্থ পাচার হচ্ছে, তার সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, এই পরিমাণ প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা হতে পারে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) ইতোমধ্যে সব জুয়ার ওয়েবসাইট বন্ধ করেছে, তবে ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (ভিপিএন) ব্যবহার করে জুয়া খেলা এখনও চলছে। বিটিআরসির প্রচেষ্টার পাশাপাশি ব্যাংক ও এমএফএস প্ল্যাটফর্মে এমন লেনদেন হচ্ছে কি না তা কেন্দ্রীয় ব্যাংক কঠোরভাবে মনিটর করবে।
একজন সাবেক পেশাদার জুয়ারি নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, দেশ থেকেই বেটিং অ্যাপে প্রোফাইল তৈরি করে অনলাইনে জুয়া খেলা হয়। সব ধরনের খেলাতেই বাজি ধরা যায়। যে খেলায় যার অভিজ্ঞতা বেশি, তিনি ওইসব খেলায় বেটিং করেন। তিনি আরও বলেন, মূলত যিনি অনলাইনে জুয়া খেলতে আগ্রহী, তিনি বেটিং অ্যাপে গিয়ে একটি প্রোফাইল খুলবেন। বেটিং অ্যাপ থেকে এমএফএসের একটি বিজনেস অ্যাকাউন্ট দেওয়া হয়। সেই বিজনেস অ্যাকাউন্টে আরেকটি অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা পাঠাতে হয়। আবার বেটিং শেষ হলে টাকা জিতলে টাকা উত্তোলন করে ফেলেন।
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশিরা বেটিং অ্যাপে হেরে গেলে সেই টাকা সহজেই দেশ থেকে পাচার হয়ে যায়। কিন্তু যখন তারা জেতে, তখন সেই অর্থ দেশে আনতে একাধিক বাধার সম্মুখীন হতে হয়। যেহেতু অনলাইন জুয়া বেআইনি, তাই জুয়াড়িদের পরিচয় গোপন থাকে এবং তাদের নিবন্ধনের বিবরণ প্রায়ই খুঁজে পাওয়া যায় না।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, বাংলাদেশ-এর সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল তানভীর হাসান জোহা বলেন, আজ পর্যন্ত অনলাইন প্ল্যাটফর্মে যেসব জুয়া সংঘটিত হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে এমএফএসের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছে; ব্যাংক অ্যাকাউন্টে হয়নি। আমি এ পর্যন্ত এর কোনো উদাহরণ পাইনি। তাই যেসব এমএফএস অ্যাকাউন্টে সন্দেহজনক লেনদেন হচ্ছে, সেগুলো তদন্ত করা উচিত। দুই-চারজন ধরা পড়লেই, যারা তাদের মাধ্যমে চেইন তৈরি করেছে, তাদেরকেও ট্র্যাক করা যাবে এবং পরে আরও ধরা যাবে। তিনি আরও বলেন, ব্যাংকগুলোকে মনিটরিং দল গঠন করতে বলা হয়েছে। এটি আরও আগে করা উচিত ছিল। ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপরেখা তৈরি হওয়ার সময়ই এ উদ্যোগ নেওয়া উচিত ছিল।
এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলো কী প্রতিক্রিয়া দিয়েছে?
এমএফএস প্রতিষ্ঠান নগদের মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের প্রধান মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘নগদ কোনো অবস্থায় এমন লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত নয়। অত্যন্ত সুক্ষ্মভাবে যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে নগদ লেনদেন-সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান বাছাই করে থাকে। ফলে কোনো অবস্থায় সরকারের কাছ থেকে লাইসেন্স না পেয়ে বা সরকারি সংস্থার অনুমোদনবিহীন কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষে নগদের লেনদেন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হওয়া সম্ভব নয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘সেন্ড মানি বা পার্সন-টু-পার্সন লেনদেনের ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হলো, শুধু নগদ নয়, কারও পক্ষেই বোঝা সম্ভব নয় যে লেনদেনটির আসল উদ্দেশ্য কী। তারপরেও নগদ সব সময়ই সন্দেহভাজন লেনদেনের ওপর খেয়াল রাখে। কোথাও কোনো লেনদেনে সন্দেহ হলে সেটি সংশ্লিষ্ট সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে অবহিত করা হয়।’
বিকাশের কর্পোরেট কমিউনিকেশনস বিভাগের প্রধান শামসুদ্দিন হায়দার ডালিম বলেন, ‘যদি কোনো অ্যাকাউন্টের লেনদেন সন্দেহজনক মনে হয়, আমরা স্বেচ্ছায় তা বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফআইইউ) জানাই। অনলাইন জুয়া, হুন্ডি, মানি লন্ডারিং, সন্ত্রাসী অর্থায়ন এবং অননুমোদিত অ্যাপে অর্থ স্থানান্তরসহ অবৈধ লেনদেন প্রতিরোধে নিয়মিত মনিটরিং ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিকাশের কাছে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষিত কর্মী রয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এছাড়াও অবৈধ লেনদেন প্রতিরোধে সমন্বিত প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে আমরা যেকোনো তদন্তে নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকেও প্রয়োজনীয় সহায়তা দিই। সন্দেহজনক অ্যাকাউন্টের তথ্যের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অভিযুক্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে।’
